৫.৩ ঔপনিবেশিক শাসনকালে বাংলায় নমশূদ্র আন্দোলনের বিবরণ দাও।
Answers
Answer:
উনিশ শতকে বাংলায় সর্বাধিক পিছিয়ে পড়া নিম্নবর্গের হিন্দু তথা ‘নমঃশূদ্র’ বা চণ্ডালরা নিজেদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার। আদায়ের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলে। পূর্ববাংলার খুলনা, ফরিদপুর,বরিশাল, যশোহর প্রভৃতি অঞ্চলে এই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে।
নেতৃত্বঃ- নমঃশূদ্রদের ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ও রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সচেতন করার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকজন ব্যাক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।
এঁদের মধ্যে শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর, শ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর, রাজেন্দ্রনাথ - মণ্ডল, মুকুন্দবিহারী মল্লিক, বিরাটচন্দ্র মণ্ডল, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, প্রমথরঞ্জন ঠাকুর প্রমুখের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরঃ- শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর মতুয়া নামে একটি সংগঠন গড়েনমঃশূদ্রদের মধ্যে আত্মশক্তি ও আত্মমর্যাদাবোধের বিকাশে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন।তাঁর পুত্র শ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের সময় নমঃশূদ্রদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটে। তিনি 1907 খ্রিস্টাব্দে বাংলা ও আসাম সরকারের। কাছে নমঃশূদ্রদের চাকরিতে নিয়োগের দাবি পেশ করেন। নমঃশূদ্র ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’, ‘নিখিলবঙ্গ নমঃশূদ্র সম্মেলন’-এর (1881 খ্রিঃ) মাধ্যমে নমঃশূদ্রদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া ইত্যাদির কথা তুলে ধরেন।তাঁর দাবির ভিত্তিতে ব্রিটিশ সরকার 1911 খ্রিস্টাব্দে আদমশুমারি – রিপোর্টে চণ্ডল’ নাম পরিবর্তন করে এই সম্প্রদায়কে নমঃশূদ্র’ নামে - অভিহিত করে।
বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তে সমর্থনঃ- 1905 খ্রিস্টাব্দে রাজেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে নমঃশূদ্ররা ভাইসরয় লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গকেই ও সমর্থন জানায়। তাদের মনে হয়েছিল দুই বঙ্গ আলাদা হলে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের শোষণ, অত্যাচার, বঞ্চনা থেকে পূর্ববঙ্গের নমঃশূদ্ররা ই নিষ্কৃতি পাবে।
সামাজিক মর্যাদা আদায়ঃ- সামাজিক মর্যাদা আদায় ও আর্থিক শোষণ থেকে মুক্তির জন্য নমঃশূদ্ররা জমিদার, ইংরেজ সরকার ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে 1909, 1911, 1925, 1938 খ্রিস্টাব্দে আন্দোলন গড়ে তোলে।
Explanation:
ভূমিকাঃ- বাংলায় দলিত আন্দোলনের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল নমঃশূদ্র আন্দোলন। বাংলার দলিত জাতিগুলির মধ্যে নমঃশূদ্ররা ছিলেন সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। নমঃশূদ্ররা তাদের ধর্মগুরু শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য। আন্দোলন করে।
নমঃশুদ্র আন্দোলনের সূচনাঃ- নমঃশূদ্র আন্দোলনের সূচনা হয় 1872 খ্রিস্টাব্দে, বাংলার ফরিদপুর জেলার বাখরগঞ্জ অঞ্চলে। এক বিশিষ্ট নমঃশূদ্র নেতার মায়ের শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে উঁচু জাতের লোকেরা আসতে অস্বীকার করে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে নমঃশূদ্ররা উঁচু জাতের লোকের বাড়িতে কাজ করতে অস্বীকার করে। এই ঘটনা নমঃশূদ্রদের ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করে।
নমঃশূদ্র আন্দোলনের পটভূমিঃ- বাংলার নমঃশূদ্ররা বিভিন্ন কারণে সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করেছিল।1916 খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় এবং 1917 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় নমঃশূদ্রদের সম্মেলনে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয় যে, নমঃশূদ্ররা হল অধিকাংশই দরিদ্র, কৃষক ও শ্রমজীবী। এরা উঁচু বর্ণের ভূস্বামীদের দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছে। হরিচাদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের ধর্মীয় নেতৃত্ব নমঃশূদ্রদের ঐক্যবদ্ধ হতে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
আন্দোলনঃ- হরিচাদ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত মতুয়া ধর্মসম্প্রদায়কে কেন্দ্র করেই নমঃশূদ্রদের সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়। তাদের আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দি গ্রাম। নমঃশুদ্ররা এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য 1902 খ্রিস্টাব্দে একটি সমিতি গঠন করে এবং নিয়মিত উন্নয়নী সভার আয়োজন করে। তা ছাড়া যাত্রানুষ্ঠান ও প্রতি পরিবার থেকে মুষ্টি’ সংগ্রহের মাধ্যমেও আন্দোলনের বিস্তার ঘটে। নমঃশূদ্ররা 1912 খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গল নমঃশূদ্র অ্যাসোসিয়েশন’ (Bengal Namasudra Association) প্রতিষ্ঠা করে পুরোপুরি সংগঠিত হয়ে আন্দোলন পরিচালনা করে।নমঃশূদ্ররা তাদের নমঃশূদ্র নামের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দাবি করেছিল। 1911 খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারিতে তাদের নমঃশূদ্র নামকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।নমঃশূদ্ররা তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে কিছু সুযোগসুবিধার দাবি করে এবং এক্ষেত্রে তারা কিছু সুযোগসুবিধা লাভে সক্ষমও হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নমঃশূদ্রদের দাবি ছিল পৃথক নির্বাচন ও স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়ানো। ব্রিটিশ সরকার এক্ষেত্রেও নমঃশূদ্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। তাই নমঃশুদ্ররাও ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেনি।
মূল্যায়নঃ- বাংলার দলিত আন্দোলনের ইতিহাসে নমঃশুদ্র আন্দোলন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠিত নমঃশূদ্র আন্দোলন ভারতের অন্যান্য দলিত আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল।