নবজাগরণ কেন হয়েছিল?
Answers
Explanation:
আর্থ-সামাজিক কাঠামো থেকে শুরু করে মানুষের মূল্যবোধ ও অবস্থার বিশাল পরিবর্তন, প্রকৃতি বিজ্ঞানের সূচনা, বিশ্বের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে জীবনের আগমন, ধর্মের নীতিগুলির চেয়ে মানুষের যুক্তি।
আরে সাথী আপনার উত্তর এখানে অনুসরণ করুন
নবজাগরণ (রেনেসাঁ) প্রথম শুরু হয় ইতালিতে এবং পরিপূর্ণ বিকাশ ইতালিতে ইতালি। ইতালি হতে ক্রমে ক্রমে রেনেসাঁসের প্রভাব ইউরোপের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে ।
নবজাগরণ ( রেনেসাঁ ) শুরু হওয়ার পিছনে কতগুলো কারণ ছিল। নিম্নে তা আলোচনা করা হল:
১)ভৌগলিক অবস্থান:
ইতালি ভূমধ্যসাগরে মধ্যস্থলে অবস্থিত হওয়াতেই ভূমধ্যসাগরকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক কেন্দ্রস্থল ছিল ইতালি।ক্রসেডের সূত্র ধরে ইউরোপে ও আরব দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল তার সর্বাপেক্ষা অধিক সুযোগ গ্রহণ করেছিল ইতালির শহরগুলো। কেবল ব্যবসা-বাণিজ্য নয় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও আরবদের প্রভাব ইতালি সড়কগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে প্রভৃতি স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।ফ্লোরেন্স, ভেনিস মিলন ইত্যাদি শহর গুলো গড়ে ওঠে ।উপরন্তু সাগর তীরবর্তী অবস্থানের কারণে ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো করতে পারেনি । সুতরাং রেনেসাঁ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ পরিস্থিতি ইতালিতে ছিল বলে আমরা মনে করি ।
২)কনস্টান্টিনোপলের পতন :
ইতালিতে রেনেসাঁ শুরু হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের পতন। ১৪৫৩ সালে উসমানীয় তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ এই শহরটি দখল করলে এখানকার পণ্ডিতেরা ইতালিতে গিয়ে পাড়ি জমায় ।সঙ্গে তারা নিয়ে আসেন গ্রিক -সাহিত্যের মূল্যবান পান্ডুলিপি। এসকল পণ্ডিতেরা ইতালির বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পেশায় যোগদান করেন এবং সাফল্যের সাথে তারা এসব কাজ পরিচালনা করেন ।তাদের ইতালিতে আগমনের ফলে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান যুগের শিল্প সাহিত্য, দর্শন ,ইতিহাস, গণিত, বিজ্ঞান, প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা জ্বলে উঠে । জেগে উঠে জ্ঞানের প্রতি উৎসাহ-উদ্দীপনা ।মানুষ জ্ঞানের জন্য বসে থাকে ,সৃষ্টি হয় চিন্তাজগতের আলোড়ন যার ফলশ্রুতিতে ইতালিতে প্রথম রেনেসাঁ সূত্রপাত হয় ।
৩)ইতালির শহরগুলোর অবদান :
রেনেসাঁর সৃষ্টিতে ইতালির শহর গুলোর অপরিসীম অবদান রয়েছে । ইতালির দক্ষিণের ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে শহরগুলো গড়ে উঠেছিল ।এ শহর গুলোর অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল বাণিজ্য । বাণিজ্যের প্রয়োজনে এ শহর গুলোতে গড়ে ওঠে ছোট ছোট কারখানা ।ইউরোপের সামন্তবাদী আর্থসামাজিক কাঠামোর প্রভাবের শহরগুলোতে খুবই কম ছিল।ফলে এ শহরগুলোতে স্বাধীন চিন্তা চেতনার ব্যক্তিত্বের বিকাশ এবং নাগরিক আদর্শ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ ছিল ।মানুষের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ এখানে ছিল। এতে স্বাধীনভাবে মানুষের মন মানসিকতা, উদারনৈতিক ভাবনা ,ধর্ম নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, সাহিত্য, শিল্পকলার , প্রতি মানুষের গভীর আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছিল ।বস্তুত জেনোয়া, ফ্লোরেন্স ,ভেনিস, মিলন প্রভৃতি শহর ইতালির রেনেসাঁ সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। বিশেষ করে ফ্লোরেন্স শহরটিকে বলা হয় দ্বিতীয় এথেন্স ।
৪)ইতালির মানবতাবাদি পণ্ডিতদের অবদান:
ইতালিতে মানবতাবাদীদের অবদান ছিল অসামান্য।জ্ঞানের সাধক এসকল পণ্ডিতেরা মানুষের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন। মানুষকে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। অতীত যুগের ইতিহাস ,সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা ,দর্শন প্রভৃতি অর্জন করে অর্জিত জ্ঞান সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা ছিল তাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য। মধ্যযুগের শিক্ষা ছিল ধর্ম সাপেক্ষ। কিন্তু প্রাচীন রোমান শিল্প-সাহিত্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ।সেগুলোর বিষয়বস্তু ছিল মানুষ ও প্রকৃতি নিয়ে। মানবতাবাদি পণ্ডিতেরা প্রাচীন পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে ,অনুবাদ করে, প্রতিলিপি প্রস্তুত করে প্রচার করত। তারা তরুণদের নতুন নতুন জিজ্ঞাসা এবং জ্ঞানের আলো জাগিয়ে তুলতো । ইতালিতে এরকম মানবতাবাদ পণ্ডিতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন পেত্রার্ক,বোককাচো, দান্তে,ইত্যাদি।আরো ছিলেন মানবতাবাদি মহান চিত্রশিল্পী যেমন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি রাফায়েল মাইকেলেঞ্জেলো তাদের শিল্পকর্ম ইতালিতে বলিষ্ঠ অবদান রেখেছিল ।
৫) ধর্ম প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান:
রাজনৈতিক দুর্যোগের মধ্যে ও ইতালির খ্রিষ্টান প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা অক্ষুন্ন রেখেছিল ।তারা রোমের প্রাচীন ঐতিহ্য ও গৌরবের অক্ষুন্ন রাখতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। ল্যাটিন ভাষায় উন্নতি সাধনে অনেক অবদান রেখেছিল। প্রাচীন পান্ডুলিপি উদ্ধার ও সংরক্ষণে রোমের পোপ পঞ্চম নিকোলাস ,দ্বিতীয় জুলিয়াস, ও দশম লিওয়ের অবদান অনস্বীকার্য ।তারা নতুন নতুন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করে। প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও অন্যান্য মূল্যবান প্রাচীন শিল্প সাহিত্য নিদর্শন ধরে রাখতে ব্যবস্থা করেছিল। শিক্ষার্থীরা বিনা বাধায় সেসব স্থানে সাহিত্যচর্চা ,ও সাহিত্য বিষয়ক গবেষণা করতে পারতো,এবং জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এই কারণে রেনেসাঁসের গতিকে ত্বরান্বিত করেছিল ।
৬)বিভিন্ন জাতির মিলনকেন্দ্র :
প্রথম রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের সময় থেকেই ইতালি গথ,লোম্বার্ড,ফ্রাংক, স্যারাসেন,নর্মান ও জার্মান জাতির মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল ।এ সূত্রে রোমান, বাইজানটাইন, আরব ,জার্মান, প্রভৃতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির যোগাযোগের ফলে ইতালিতে এক নবচেতনা ও সংস্কৃতির ব্যাপক উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল ।
৮)রোমান সভ্যতার চিহ্ন :
ইতালির প্রায় সর্বত্র প্রাচীন রোমান সভ্যতার শিল্প ,সাহিত্য ,ভাস্কর্য, স্থাপত্যকলার, চিহ্ন বিদ্যমান থাকায় রেনেসাঁসের প্রভাব ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছিল ।
৯)ধর্ম নিরপেক্ষ পাঠদান :
ইতালির বিভিন্ন শহরের যে সকল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ,গড়ে উঠেছিল সেগুলো প্রত্যেকটিতে ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও বাস্তব জীবনের কার্যকরী শিক্ষাব্যবস্থা। আত্তার অবনতি না ঘটেয়ে সুন্দর জীবন যাপন করতে পারে। কিভাবে সুখকর জীবনযাপন করতে পারে সে ব্যবস্থা তারা ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছিল।শিক্ষার এর ধারণাই ইতালির অধিবাসীদেরকে রেনেসাঁসের বীজ রোপনের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করে দিয়েছিল ।
পরিশেষে একথা বলতে পারি যে, উপযুক্ত কারণ গুলো সমষ্টিগত ফলস্বরূপ পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইতালিতে রেনেসাঁসের সূত্রপাত হয়েছিল বা রেনেসাঁ সৃষ্টি হয়েছিল ।