চিরস্থায়ী বন্দবস্তের অর্থনৈতিক প্রভাব
Answers
Answer+Explanation:
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার অবক্ষয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলবৎ করার অব্যবহিত পরেই জমিদারের শক্তি ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দেয়। এর পরে একটা সময়ের জন্য এ ব্যবস্থায় স্থিতি বিরাজ করে। এমনকি, জমিদার শ্রেণির একটা তুলনামূলক সমৃদ্ধিও দেখা দেয়। কয়েক দফা আইনে (১৭৯৫-এর ৩৫ নং প্রবিধান, ১৭৯৯-এর ৭ নং প্রবিধান, ১৮১২ সালের ৫ নং প্রবিধান এবং ১৮১৯-এর ৮ নং প্রবিধান) প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত ক্ষমতাবলে জমিদারগণ তাদের খাজনা বৃদ্ধি ও দ্রুত আদায়ের অধিকার লাভ করেন। রাজস্ব বকেয়া থাকার কারণে জমিদারি তালুকের প্রকাশ্য বিক্রয় ১৮২০ সালের পর থেকে বিরল ঘটনা হয়ে ওঠে। ১৮১৩ সালে বাংলা অবাধ বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর এখান থেকে প্রাথমিক পণ্যাদি আরও বেশি পরিমাণে রপ্তানি হতে থাকে ও জমিদারি আয়ের ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সে কারণে কৃষি সম্প্রসারণ, বাণিজ্যিক জাতের ফসলের আবাদ ও মূল্যের ঊর্ধ্ব গতি এ সবই জমিদারি অর্থনীতিতে অনুকূল প্রভাব ফেলে।
তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে জমিদার শ্রেণির সমৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকদের জীবনে অনুরূপ সমৃদ্ধি আসে নি। চাষির উদ্বৃত্ত সম্পদ জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা খাজনা ও নানা ধরনের চাঁদা যেমন, আবওয়াব, তুহুরি, দস্তরি, ভেট, নজরানা, বেগার, সালামি ইত্যাদি রূপে পরিকল্পিতভাবে শোষণ করে। ফলে চাষিরা শুধু খাজনা পরিশোধ ও জীবন ধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন সে পরিমাণ উৎপাদন করে যেতে থাকে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বিশ্ব পর্যায়ের পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাথে বাংলা সম্পর্কিত হবার পর, পল্লী জনপদের জীবনধারণ ও অর্থনীতি আরও প্রচন্ড চাপের মুখে পড়ে। বাংলার প্রায় সর্বত্র, বিশেষ করে, পূর্ববঙ্গে ১৮৫০-এর দশকের শেষভাগ থেকে কয়েক দফা কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। এ ছিল জমিদার ও রায়তদের মধ্যে ক্ষুণ্ণ সম্পর্কের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ বহিঃপ্রকাশ। প্রথমে সাঁওতাল পরগনায় কৃষক গোলযোগ (১৮৫৫) দিয়ে এ সঙ্কটের সূচনা ঘটে। এরপর নীল চাষ হয় এমন সব জেলায় দেখা দেয় নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬১)। ১৮৫৮ সাল থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত নীল প্রতিরোধ আন্দোলন চলে। ১৮৭০-এর দশক ও ১৮৮০-র দশকের প্রথমভাগে কৃষক প্রতিরোধ উদ্বেগজনক মোড় নেয়। এ সময় বাংলার কোনো কোনো এলাকায় চাষিরা জমিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ও জমিদারদের উদ্বৃত্ত শোষণ ন্যূনতম করার লক্ষ্যে একত্রে জোট বাঁধে। এ আমলে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলনগুলি হলো তুষখালি (বাকেরগঞ্জ) কৃষক আন্দোলন (১৮৭২-৭৫), পাবনা কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭৩), ময়মনসিংহ উপজাতীয় কৃষক আন্দোলন (১৮৭৪-১৮৮২), মুন্সীগঞ্জ (ঢাকা) কৃষক আন্দোলন (১৮৮০-৮১) ও মেহেন্দীগঞ্জ (বাকেরগঞ্জ) কৃষক বিদ্রোহ (১৮৮০-৮১)। ফরায়েজীরা (মুসলিম সংস্কারবাদী একটি সম্প্রদায়) কৃষক স্বার্থের পক্ষে ভূমিকা গ্রহণ করে এবং গোটা দেশজুড়ে, বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলায় জমিদারি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ব্যাপক সাংগঠনিক কার্যক্রম গড়ে তোলে। এ প্রতিরোধ আন্দোলনরত চাষি জোটগুলির অভিন্ন দাবি ছিল জমিতে রায়তের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
এসব বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ আন্দোলনের কারণে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার অবক্ষয় শুরু হয়। স্বত্বাধিকারী তথা জমির মালিক শ্রেণি রায়ত বা প্রজাদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। রায়তগণ জমিতে তাদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হয়। জমিদারগণ বিদ্রোহী রায়তদের সামাল দিতে না পেরে তাদের শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে সরকারের সাহায্য, এমনকি প্রয়োজনে বিদ্রোহ শান্ত করার জন্য সামরিক বাহিনীর সাহায্য চায়। উপনিবেশ ও সাম্রাজ্য রক্ষার কারণে এর প্রয়োজন দেখা দেয়। কৃষকদের প্রতিবাদ-আন্দোলন সম্পর্কিত প্রায় সকল সরকারি প্রতিবেদনে জমিদার শ্রেণির দুর্বল অবস্থার কথা, বিশেষ করে এর দারিদ্রাবস্থার উল্লেখ করা হয়। উত্তরাধিকার আইনের কারণে তালুকগুলির বিভক্তি ও পুনর্বিভাজন ঘটে। এ ছাড়াও পারিবারিক কলহ, বিবাদ-বিসম্বাদ, জমিদারিতে অনুপস্থিতির প্রবণতা, মধ্যস্থ বন্দোবস্ত সৃষ্টি, স্বত্বাধিকারীর অকাল মৃত্যু, ব্যয়বাহুল্য ও আরও নানাবিধ কারণে জমিদার শ্রেণি কাঠামোটি অবক্ষয়ের কবলে পড়ে। উনিশ শতকের প্রথম ২৫ বছরে মধ্যস্বত্ব বা মধ্যস্থ বন্দোবস্তধারী ব্যক্তিদের অবয়বে এক অবস্থাপন্ন ও প্রত্যয়ী আবাদি মধ্যবিত্ত শ্রেণি, জোতদার, হাওলাদার ও অন্যান্য বিত্তবান কৃষকের আবির্ভাব ঘটতে থাকে।