বহুত্ববাদ কী ? ভারতীয় সমােজ বহুত্ববাদের প্রকৃত আেলাচনা কর।বর্তমান ভারেত বহুত্ববাদের বাধাগুলি আেলাচনা কর।
Answers
Answer:
৭০ বছর আগে ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে জওহরলাল নেহরু ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। নেহরুর ভাষায় ব্যাপারটি ছিল এ রকম, ‘এই ক্ষণ ইতিহাসের পাতায় বিরল এক ঘটনা, যখন আমরা পুরোনো থেকে নতুনের দিকে অগ্রসর হই, যখন এক যুগের অবসান হয় এবং যখন দীর্ঘকাল অবদমিত থাকা জাতির আত্মা মুক্ত হয়।’ এর সঙ্গে জাতি শাসনব্যবস্থা নিয়ে এক অনন্যসাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে, যার জের এখনো চলছে।
তবে উইনস্টন চার্চিল ভেবেছিলেন, এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভব নয়। তিনি একবার এই সম্ভাবনা খারিজ করে বলে উঠেছিলেন, ‘ভারত স্রেফ এক ভৌগোলিক সত্তা, বিষুবরেখা যদি একটি দেশ হয়, তাহলে ভারতও একটি দেশ।’ ভারতের ব্যাপারে চার্চিলের বক্তব্যে সত্যতার উপাদান খুব বেশি নেই। কিন্তু এটাও সত্য, পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রে ভারতের মতো এমন বিচিত্র জাতি, পরস্পরের কাছে অবোধ্য ভাষা, জলবায়ু ও ভূমির বৈচিত্র্য, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও বৈষম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের নজির দেখা যায় না।
কখনো কখনো কিছুটা কৌতুক করে বলা হয়, ‘ভারত সম্পর্কে আপনি যা বলবেন, তার বিপরীতটাও সত্য।’ অর্থাৎ ভারত সম্পর্কে
যত স্বতঃসিদ্ধ সত্য রয়েছে, তেমনি তার বিপরীতটাও সত্য। বস্তুত, ভারত সম্পর্কে যে একটি সত্য বলা যায় তা হলো, এটি এক বহুমুখী রাষ্ট্র। সেই ক্লিশে কথাটি ধার করে বলা যায়, ভারতীয়রা বহু রকম।
এখানে কোনো একক প্রমিত মান বা গৎবাঁধা কিছু নেই, একক মনোভঙ্গি নেই। এমনকি জাতীয় মূলমন্ত্র সত্যমেভ জয়তে (সত্যেরই জয় হয়) নানাভাবে বোঝা সম্ভব। ভারতের অন্তত ১৩০ কোটি সত্যের অস্তিত্ব রয়েছে, যদি না সর্বশেষ জনগণনায় আমাদের ভুলভাবে গণনা করা হয়।
এই বৈচিত্র্য ও জটিলতার কারণে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ই পি টম্পসন বলেছিলেন, ‘ভারত সম্ভবত ভবিষ্যৎ বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ।’ তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সব সমধর্মী বৈশিষ্ট্য এই সমাজের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে...পূর্ব বা পশ্চিমের এমন কোনো চিন্তা নেই, যা কোনো না কোনো ভারতীয়র মনে সক্রিয় নেই।’
ভারতের বিভিন্ন কাজকারবার যেভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে, তাতে দেশটির ব্যতিক্রমী বহুত্ববাদ স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। যখন অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশ জাতি গঠন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কর্তৃত্ববাদী শাসন মডেল গ্রহণ করেছে, তখন ভারত বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। কথা হলো, গণতন্ত্র নিয়মরীতির তোয়াক্কা না-ও করতে পারে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ হতে পারে।
কিন্তু অনেক চাপ ও শক্তিক্ষয় সত্ত্বেও ভারতে গণতন্ত্র টিকে গেছে এবং বিকশিত হচ্ছে যদিও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, যা ২২ মাস স্থায়ী হয়।
এটা ঠিক, অনেকের কাছেই মনে হয়, ভারত একটি বিশৃঙ্খল, লক্ষ্যহীন ও বিভাজিত জাতি, একুশ শতকে পথ চলতে গিয়ে যে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। কিন্তু অনন্য বৈচিত্র্যের কারণে এটি শুধু দেশ নয়, এটা এক রোমাঞ্চের মতো। এখানে সব পথই খোলা আছে এবং সবকিছুই সম্ভব।
ভারতের জাতীয়তা ভাষাভিত্তিক নয়; কারণ, দেশটিতে অন্তত ২৩ এবং সম্ভবত ৩৫টি ভাষা আছে, এখন আমরা সংবিধান না ভাষাতাত্ত্বিকদের বিশ্বাস করব, সেটা আমাদের ব্যাপার। এটি ভৌগোলিক সত্তাও নয়। অন্যদিকে এই জাতীয়তা জাতিভিত্তিকও নয়। অনেক ভারতীয়র সঙ্গে স্বদেশিদের চেয়ে বিদেশিদের মিল বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতের পাঞ্জাবি ও বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তান ও বাংলাদেশিদের বেশি মিল রয়েছে, পুনে ও বেঙ্গালুরুর অধিবাসীদের চেয়ে।
চূড়ান্ত বিচারে বলতে হয়, ভারতীয় জাতীয়তা ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি। মানবজাতির যত বিশ্বাস আছে, তার সবই ভারতে পাওয়া যাবে। এমনকি হিন্দুধর্মও একক বিশ্বাসের ধর্ম নয়, তার নানা রূপ দেখা যায়, তার কোনো জাতীয় প্রতিষ্ঠান নেই, নেই গির্জার মতো প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় আধিপত্যপরম্পরা।
ভারতীয় জাতীয়তা একটি ধারণার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, সেটা হলো, ভারত এক চিরস্থায়ী ভূমি, যার উৎপত্তি হয়েছে প্রাচীন সভ্যতা
থেকে, যার অভিন্ন ইতিহাস টিকে আছে বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের জোরে। এই ভূমি নাগরিকদের ওপর সংকীর্ণ ধারণা চাপিয়ে দেয় না। আপনি অনেক কিছু হতে পারেন, আবার একটা কিছু হতে পারেন।
আপনি একই সঙ্গে ভালো মুসলমান, ভালো কেরালাবাসী ও উত্তম ভারতীয় হতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ধাতু গলানোর পাত্র হয়, তাহলে ভারত থালার মতো, যেখানে বাটিতে বাটিতে নানা পদ থরে থরে সাজানো থাকে। এর প্রতিটির স্বাদ ভিন্ন, যা অন্যটির সঙ্গে ঠিকঠাক খাপ খায় না। কিন্তু তারা একটি আরেকটির পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। মাইকেল ইগনেতিয়েফের কথা উল্টে দিয়ে বলা যায়, ভারত অঙ্গীভবনের দেশ, রক্তের নয়।
ফলে ভারত নিজের ভূমিতে বহু মানুষকে আপন করে নিয়েছে। এখানে জাতি, বর্ণ, প্রথা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ও প্রথার হাজারো ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও মানুষ এক গণতান্ত্রিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে বসবাস করছে, সেটা হলো কেউ কারও সঙ্গে একমত হতে পারে না। এই নিয়মের ভিত্তিতে ভারত ৭০ বছর ধরে টিকে আছে। ফলে সে এমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে যে মানুষ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ভারতের অখণ্ডতা টিকবে না।
ভারতের প্রতিষ্ঠাতারা নিজেদের স্বপ্নের আলোকে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। আমরা তাঁদের আদর্শের ছাড়পত্র দিয়েছি। কিন্তু আজ এই আদর্শ ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা ও যুদ্ধংদেহী সংখ্যাগরিষ্ঠতার খপ্পরে পড়েছে।
৭০তম স্বাধীনতা দিবসে প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের উচিত অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক ও ন্যায্য ভারত নির্মাণে নিজেদের আবারও উৎসর্গ করা, যে ভারতকে স্বাধীন করতে মহাত্মা গান্ধী লড়াই করেছেন।
Explanation:
please mark as brain list