জমিদার সভা কে কেন ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত বলা হয়
Answers
Answer:
জমিদার সভা (Landholders' Society) :-
উনিশ শতকের প্রথমভাগে ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে । এই সময়ে গড়ে উঠা রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল 'জমিদার সভা' । ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে উদ্ভূত জমিদার শ্রেণি ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের পর রাজনৈতিক নেতৃত্বদানে এগিয়ে আসে । ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই নভেম্বর দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে এবং রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে কলকাতায় 'জমিদার সভা' বা 'ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি' প্রতিষ্ঠিত হয় । এই সভার যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন প্রসন্ন কুমার ঠাকুর ও ডাব্লিউ. সি. হ্যারি । সভার প্রাণপুরুষ ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর । সভার কার্যনির্বাহক সমিতির সকল সদস্যই ছিলেন প্রতিষ্ঠিত জমিদার । এই সভার এক ঘোষণাপত্রে বলা হয় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশীয় স্বার্থযুক্ত প্রত্যেককেই এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য হতে পারে ।
সভার ঘোষিত উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে সংকীর্ণ জাতিভেদ বা আঞ্চলিকতাবাদের প্রশ্রয় ছিল না । প্রথমদিকে এই সভার রাজনৈতিক চিন্তাধারা ছিল যথেষ্ট উদারনৈতিক । জমিদার সভার প্রধান ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল জমিদার ও জমির মালিকদের সাধারণ স্বার্থরক্ষা করা । সভার অন্যতম নেতা রাজেন্দ্রলাল মিত্র ভূমিমালিকের সাধারণ স্বার্থের পাশাপাশি রায়তের অধিকার রক্ষার কথা বলেন । তিনি এই সভার মাধ্যমে ভারতবাসীর নিয়মতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন । জমিদারদের সঙ্গে প্রজাদের স্বার্থ জড়িয়ে থাকায় এই সভা উভয় শ্রেণির দাবি আদায়ের লক্ষ্য গ্রহণ করে ।
জমিদার সভা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে —
(i) জমিদারদের স্বার্থরক্ষার জন্য তারা সরকারের কাছে দাবি জানায় ।
(ii) ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করে ।
(iii) ভারতের সর্বত্র চিরস্তায়ী বন্দোবস্তের প্রসার ঘটানোর দাবি জানায় ।
(iv) নিষ্কর জমি ভোগদখলের অধিকার পুনঃপ্রবর্তন বন্ধ করার চেষ্টা চালায় ।
(v) শাসনসংস্কারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায় ।
(vi) পুলিশবিভাগ, বিচারবিভাগ ও রাজস্ববিভাগের সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায় ।
এই সভা তার আদর্শ ও লক্ষ্য প্রচারের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় শাখা গড়ে তোলে । ফলে দেশ জুড়ে এক সংগঠিত আন্দোলন গড়ে ওঠে । ভারতীয়দের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । এই সভার আবেদনে সরকার প্রতিটি গ্রামে কিছু পরিমাণ নিষ্কর জমি রাখার বন্দোবস্ত করে । জমিদারদের স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যে গড়ে উঠলেও এই সভা রাজনৈতিক অধিকারের দাবি জানায় । এই সমিতি ভারতীয়দের আশা আকাঙ্খার প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন ও উদারনৈতিক ইংরেজদের সমর্থন লাভ করেছিল । টাউন হলে আয়োজিত জমিদার সভার এক সমাবেশে দ্বারকানাথ ঠাকুর বলেছিলেন যে, এক সময় আসবে যখন হিন্দু কলেজের ছাত্ররা নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা করার ও নিজেদের অভিযোগ নিরসন করার জন্য এক বলিষ্ঠ দেশপ্রেমিক সঙ্ঘ গড়ে তুলবে । ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জমিদার সভা ক্রমে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে । ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এর অস্তিত্ব কোনরকমে টিকে ছিল । পরবর্তীকালে বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি এই সভার স্থান দখল করে নেয় ।