খ লোকসাহিত্যের সংজ্ঞা নিরূপণ করো লোকসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য গুলি সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা করে একটি নিবন্ধ রচনা করো
Answers
Answer:
অতীত ঐতিহ্য ও বর্তমান অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে রচিত হয়। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিমন্ডলে একটি সংহত সমাজমানস থেকে এর উদ্ভব। সাধারণত অক্ষরজ্ঞানহীন পল্লিবাসীরা স্মৃতি ও শ্রুতির ওপর নির্ভর করে এর লালন করে। মূলে ব্যক্তিবিশেষের রচনা হলেও সমষ্টির চর্চায় তা পুষ্টি ও পরিপক্কতা লাভ করে। এজন্য লোকসাহিত্য সমষ্টির ঐতিহ্য, আবেগ, চিন্তা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে। বিষয়, ভাষা ও রীতির ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারাই এতে অনুসৃত হয়। কল্পনাশক্তি, উদ্ভাবন-ক্ষমতা ও পরিশীলিত চিন্তার অভাব থাকলেও লোকসাহিত্যে শিল্পসৌন্দর্য, রস ও আনন্দবোধের অভাব থাকে না।
লোকসাহিত্য লোকসংস্কৃতির একটি জীবন্ত ধারা; এর মধ্য দিয়ে জাতির আত্মার স্পন্দন শোনা যায়। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একে ‘জনপদের হূদয়-কলরব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। লোকসাহিত্যকে প্রধানত লোকসঙ্গীত, গীতিকা, লোককাহিনী, লোকনাট্য, ছড়া, মন্ত্র, ধাঁধা ও প্রবাদ এই আটটি শাখায় ভাগ করা যায়।
লোকসঙ্গীত ঐতিহ্যগতভাবে বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত গান; সাধারণত পল্লীর অনক্ষর জনগণ এর প্রধান ধারক। বিষয়, কাল ও উপলক্ষভেদে এ গানের অবয়ব ছোট-বড় হয়। ধুয়া, অন্তরা, অস্থায়ী ও আভোগ সম্বলিত দশ-বারো চরণের লোকসঙ্গীত আছে; আবার ব্রতগান, মেয়েলী গীত, মাগনের গান, জারি গান, গম্ভীরা গান ইত্যাদি আকারে অপেক্ষাকৃত বড় হয়। কবির লড়াই, আলকাপ গান, লেটো গান এবং যাত্রাগান হয় আরও দীর্ঘ, কারণ সারারাত ধরে এগুলি পরিবেশিত হয়।
লোকসঙ্গীতের গায়করা পেশাদার ও অপেশাদার উভয়ই হতে পারে। পেশাদার কোনো গায়েন বা বয়াতি দল গঠন করে অর্থের বিনিময়ে গান গায়; কবিয়াল দলবল নিয়ে কবির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। আলকাপ গানের ছোকরা এবং ঘাটু গানের ঘাটু পেশাদার নটী ও গায়ক; উদাস বাউল নিজেই গান করে তার অধ্যাত্মপিপাসা নিবৃত্ত করে। বৈরাগী-বৈরাগিণী বা বোষ্টম-বোষ্টমী গান গেয়ে ভিক্ষা করে। বিবাহাদি অনুষ্ঠানে মেয়েলি গীত গাওয়ার জন্য পেশাদার গিদাল থাকে; তবে সাধারণ মেয়েরাও গান গায়। ক্ষেত-খামারে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ, মাঠে-ঘাটে রাখাল এবং নদী-হাওরে মাঝি-মাল্লারাও চিত্তবিনোদন, অবসরযাপন বা শ্রম লাঘবের জন্য গান গায়।
বাংলা লোকসঙ্গীত নাম ও প্রকারভেদে বিচিত্র; অঞ্চলভেদে এর প্রায় শতাধিক নাম রয়েছে এবং প্রকারভেদে প্রায় পঞ্চাশোর্ধ্ব শ্রেণির গান চিহ্নিত করা যায়। কেউ কেউ আঞ্চলিক ও সর্বাঞ্চলীয়, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক, সাধারণ ও তত্ত্বপ্রধান, তালযুক্ত ও তালহীন এরূপ স্থূলভাবে ভাগ করে সেগুলির আবার নানা উপবিভাগ করেছেন। আশুতোষ ভট্টাচার্য লোকসঙ্গীতকে আঞ্চলিক, ব্যবহারিক, আনুষ্ঠানিক (ritual), কর্মমূলক ও প্রেমমূলক এই পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। বিষয়গত দিক থেকে একে প্রেম, ধর্ম-আচার-সংস্কার, তত্ত্ব ও ভক্তি, কর্ম ও শ্রম, পেশা ও বৃত্তি, ব্যঙ্গ ও হাস্যকৌতুক এবং মিশ্র এরূপ সাতটি ভাগ করা যায়।
নর-নারীর প্রেম অবলম্বন করে রচিত বাংলা লোকসঙ্গীতে লৌকিক বা পার্থিব প্রেম এবং তত্ত্ব-ভক্তিমূলক গানে অলৌকিক বা অপার্থিব প্রেমের কথা আছে। রাধাকৃষ্ণের আখ্যান অবলম্বনে রচিত আলকাপ, কবিগান, ঘাটু গান, ঝুমুর, বারমাসি, মেয়েলি গীত, যাত্রাগান, সারি গান, হোলির গান ইত্যাদিতে দেহজ কামনা-বাসনা, মান-অভিমান, মিলন-বিরহ ইত্যাদি ব্যক্ত হয়। যেমন ‘বনে কানুর বাঁশি বাজিল রে’ (আলকাপ), ‘কি হেরিলাম যমুনায় আসিয়া গো সজনি’ (ঘাটু গান), ‘শুন গো রাই, বলি তোরে’ (ঝুমুর), ‘মাঘ না মাসেতে মাধব মতুরায় গমন’ (বারোমাসি), ‘তুই মোরে নিদয়ার কালিয়া রে’ (ভাওয়াইয়া), ‘মন দুঃখে মরিবে সুবল সখা’ (বিচ্ছেদি গান), ‘সুন্দরী লো বাইরইয়া দেখ, শ্যামে বাঁশি বাজাইয়া যায় রে’ (সারিগান), ‘নিধুবনে শ্যাম কিশোর সনে খেলব হোলি আয়’ (হোলির গান) ইত্যাদি। এ গানগুলিতে রাধা, কৃষ্ণ, সুবল, মথুরা, যমুনা, বাঁশি ইত্যাদি শব্দ থাকলেও তাতে ধর্মীয় ভাব বা আধ্যাত্মিকতা নেই, আছে মানবিকবোধ ও বৈষয়িক চেতনা। গাড়িয়াল, মৈষাল, মাহুত, মাঝি, সওদাগর, বানিয়া, নদী, হাওর প্রভৃতি বাংলার পেশাজীবী মানুষ ও প্রকৃতি নিয়েও এ ধরণের গান রচিত হয়। ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে’ (ভাওয়াইয়া), ‘আরে গেইলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধু’ (ওই), ‘আমার বাড়ি যান ও মোর প্রাণের মৈষাল রে’ (চটকা), ‘ও মোর বানিয়া বন্ধু রে’ (ওই), ‘সুজন মাঝি রে, কোন ঘাটে লাগাইবা তোর নাও’ (ভাটিয়ালি), ‘সুন্দইর্যা মাঝির নাও উজান চলো ধাইয়া’ (সারিগান) ইত্যাদি গানে রূপক-প্রতীক নেই, আছে নিত্য পরিচিত মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতির চিত্র।
জীবনের খন্ড খন্ড চিত্র কথায় ও সুরে অবলীলায় রূপ দিয়েছেন লোকশিল্পীরা। ‘গাও তোল গাও তোল কন্যা হে, কন্যা পিন্দো বিয়ার শাড়ি’, ‘ঘাটে ডিঙ্গা লাগাইয়া মাঝি পান খেয়া যাও’, ‘কত পাষাণ বাইন্দ্যাছ পতি মনেতে’, ‘জল ভর সুন্দরী কন্যা জলে দিয়া মন’, ‘লাল নীল চউর বাইয়া, হাটে যাও রে সোনার নাইয়া’ ইত্যাদি প্রেমসঙ্গীতে জীবনের খন্ডচিত্র আবেগের ভাষায় রূপ পেয়েছে।