বাংলা রচনা বর্ষ বিদ্যুৎ বাতি
Answers
Answer:
ভূমিকা:
অনন্ত সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হল মানুষ। সেই সূচনা কাল থেকে অজানাকে জানবার, অচেনাকে চেনবার ও অদেখাকে দেখবার আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে আপন বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের মাধ্যমে ইতিহাসের পথে অন্য সকল প্রাণীর তুলনায় উন্নত হয়ে উঠেছে এবং একই সাথে বিবর্তিত হয়েছে। এই বিবর্তনের সঙ্গে ধীরে ধীরে মানুষ সংঘবদ্ধ হয়েছে, গড়ে তুলেছে সমাজ, যা পরিণতি পেয়েছে আধুনিক সভ্যতায়।
আধুনিক যুগে মানুষের এমনই আরেকটি যুগান্তকারী আবিষ্কার হল বিদ্যুৎ। এই বিদ্যুতের আবিষ্কার মানুষের জীবন ও সভ্যতা তো বটেই, তার সাথে সাথে সমগ্র যুগের কালগত চরিত্রের ক্ষেত্রেও এক অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে।
ইতিহাসের বুকে বিদ্যুতের আবির্ভাব:
ইতিহাসের বুকে বিদ্যুতের আবির্ভাব বলতে মূলত মানুষের বিদ্যুৎ তৈরির কৌশল আবিষ্কারকে বোঝানো হয়ে থাকে। তার পূর্বে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হওয়া বিদ্যুৎ সম্পর্কে মানুষ অবগত ছিল। ইতিহাস ও পুরাণে ইল মাছের শরীর থেকে সঞ্চারিত বিদ্যুৎ কিংবা বজ্রপাতের ফলে কোন ধাতব বস্তুতে সঞ্চারিত বিদ্যুৎ সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল বলে জানা যায়।
তবে আধুনিক যুগে বিদ্যুৎ সংক্রান্ত প্রথম আবিষ্কারটি করেছিলেন সম্ভবত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম গিলবার্ট। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে তিনিই সর্বপ্রথম তড়িৎ চুম্বকত্ব সম্পর্কে লিখিত একটি বইয়ে কৃত্রিম উপায়ে বিদ্যুৎ তৈরি সংক্রান্ত আলোচনা করেন। এর পরবর্তীকালে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন-এর হাত ধরে বিদ্যুৎ সংক্রান্ত আবিষ্কার আরও অগ্রগতি করে। আঠারোশো খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা আবিষ্কার করেন তামা এবং দস্তা দিয়ে তৈরি ব্যাটারি।
এরপর সময়ের সাথে ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হন আন্দ্রেই এম্পিয়ার; যার হাত ধরে ইলেকট্রিক মোটর আবিস্কারের সাথে সাথে পৃথিবীতে তড়িৎ সম্পর্কিত ব্যবহারের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে যায়। এর কিছু পরে বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট সম্পর্কিত আবিষ্কার করেন।
সভ্যতার অগ্রগতিতে বিদ্যুতের যাত্রাপথের সূচনা:
পৃথিবীর প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানীদের বিদ্যুৎ তৈরী ও ব্যবহারের কৌশল আবিষ্কারের অব্যবহিত পর থেকেই কিভাবে সেই বিদ্যুৎকে সভ্যতার কাজে লাগানো যেতে পারে তানিয়া পৃথিবীর নানা মহলে হইচই পড়ে যায়। পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে বিদ্যুৎ প্রযুক্তি বা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি কেতাবি শাখার। বিদ্যুৎকে ব্যবহার করে যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলির সাক্ষী ছিল উনবিংশ শতাব্দী।এই শতকেই আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, টমাস আলভা এডিসন, উইলিয়াম থমসন, নিকোলা টেসলা প্রমূখ বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীদের হাত ধরে বিদ্যুৎকে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করার নানান প্রয়োজনীয় যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়।
আধুনিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টিতে বিদ্যুৎ:
বর্তমান যুগে দৈনন্দিন জীবনে প্রতিমুহূর্তে মানুষের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন বিদ্যুতের। বিদ্যুৎ ছাড়া জীবনের ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দও উপভোগ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। বিদ্যুৎকে ব্যবহার করে তৈরি হওয়া নানা বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ওপর নির্ভর করে মানুষ বর্তমান যুগে জীবন ধারণ করে থাকে।রাতের অন্ধকারে কাজ করার জন্য বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবহার থেকে শুরু করে, গরমকালে বৈদ্যুতিক পাখা, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র, টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি সকল জীবনধারণ মূলক উপাদানগুলিকে সচল রাখার জন্য প্রয়োজন বিদ্যুতের। তাছাড়া বর্তমানে মানুষ বিনোদনের জন্য মূলত যে সকল উপাদান ব্যবহার করে থাকে, সেগুলিও চলে বৈদ্যুতিক শক্তির দ্বারা। এইভাবে প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে অনন্ত নিরবিচ্ছিন্ন পরিষেবা দানের মাধ্যমে বিদ্যুৎ আদপে মানুষের জীবনের দৈনন্দিন গতিকেই বজায় রাখে।
আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণায় বিদ্যুৎ:
আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ-এর ভূমিকা অপরিসীম। বৈদ্যুতিক শক্তির সাহায্য ছাড়া বৈজ্ঞানিক গবেষণার অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তে যে সকল আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, সেই সব কিছু পরিচালিত হয় বৈদ্যুতিক শক্তির মাধ্যমে।এমনকি বিজ্ঞান গবেষণা লব্ধ ফল উপস্থাপনের জন্যও বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় বৈদ্যুতিন মাধ্যমকে। তাছাড়া বিদ্যুৎ শক্তিকে কাজে লাগিয়েও বর্তমানে বিজ্ঞান গবেষণার বিভিন্ন নতুন নতুন পথ উদ্ভাবিত হচ্ছে। বৈদ্যুতিক শক্তি বিজ্ঞানী মহলকে দেখাচ্ছে নতুন পথের দিশা। তাই বিদ্যুৎকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞান বর্তমান যুগে আর একা বিদ্যমান থাকতে পারে না।
বিদ্যুতের উৎস ও ভবিষ্যৎ:
বৈদ্যুতিক শক্তি ও আধুনিক জীবন সংক্রান্ত আলোচনায় বিদ্যুৎ-এর উৎস ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আলোচনা না করলে প্রতিবেদনটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, পৃথিবীতে বিদ্যুতের উৎস বহুমুখী হতে পারে। তবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সূচনা লগ্ন থেকে মানুষ মূলত জীবাশ্ম জ্বালানিকেই বিদ্যুতের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ পৃথিবীতে অফুরন্ত নয়।
সে কারণে পৃথিবীর সুধীজনেরা বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই বিদ্যুতের অপ্রচলিত উৎসগুলিকে বিদ্যুৎ তৈরীর জন্য ব্যবহার করার কথা বলে এসেছেন। এই সকল অপ্রচলিত শক্তির মধ্যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়তা লাভ করেছে জলবিদ্যুৎ।তাছাড়া বর্তমানে সৌরশক্তিকে কেন্দ্র করেও বিদ্যুৎ তৈরি কে বিশ্বজুড়ে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সেকারণে আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে আমরা বিদ্যুৎ তৈরির জন্য প্রচলিত উৎসগুলির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিদ্যুতের অপ্রচলিত উৎস গুলির উপর নির্ভর করতে পারব।
উপসংহার:
বিদ্যুৎ হল বর্তমান আধুনিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আধুনিক যুগে বিদ্যুৎ সংযোগ এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ হল, সমগ্র সভ্যতার স্তব্ধ হয়ে যাওয়া। আধুনিক যুগে মানব সভ্যতা যে মহান ভিত্তিগুলির ওপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারমধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিদ্যুৎ।
সে কারণে মানব সভ্যতার এই মহামূল্যবান সম্পদটির অপচয় না করে একে কি করে সভ্যতার ক্ষেত্রে আরও অগ্রগতির জন্য কাজে লাগানো যায় সে বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করতে হবে।