একটি পোড়াবাড়ির আত্মকথা রচনা
Answers
সময়ের সাথে সাথে পুরনো হয়ে যাওয়া সব জিনিসের মূল্য কমতে থাকে। জঙ্গলের মধ্যে জীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা এমনই এক পুরনো ভাঙ্গা মন্দিরের দীর্ঘকালের স্মৃতি নিয়ে আমাদের আজকের উপস্থাপন একটি ভাঙ্গা মন্দিরের আত্মকথা রচনা / একটি পুরনো মন্দিরের আত্মকথা রচনা।
ভূমিকা:
এ পৃথিবীতে সম্ভবত প্রাচীনের কোন মূল্য নেই। বস্তু কিংবা মানুষ, যাই হোক না কেন সে যত প্রাচীন হয় তার কদর বোধহয় ততই কমতে থাকে। যদি তাই না হতো তাহলে আজ আমার এই দুর্দশা হতো না।
আমি বাংলার একটি গ্রামের প্রান্তে ঘন জঙ্গলের মাঝখানে লোকচক্ষুর আড়ালে হারিয়ে যাওয়া মানুষের অবহেলায় জীর্ণ ও ভগ্নপ্রায় একটি প্রাচীন দেব মন্দির যে সময়ের গর্ভে মিলিয়ে যেতে না পেরে এখনো নিজের ধ্বংসের জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছি। আমার চেহারা যে চিরকাল আজকের মতন জীর্ণসার ছিল না তা বলাই বাহুল্য।
যৌবনে আমার শরীরে ছিল অপূর্ব জৌলুস, জনমানুষের আমার কদর ছিল। তারপর একদিন নিয়তির পরিহাসে মানুষ আমায় ভুলে গেল। সেই থেকে একলা এই ঘন অরন্যের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আমি এই দীর্ঘ জীবনের পাতা উল্টাচ্ছি আর স্মৃতিপটে নিজের আত্মকথা রচনা করে চলেছি।
আমার জন্ম বৃত্তান্ত:
আমার জন্ম সুদূর অতীত কালে। তখনো ভারতের বুকে সুলতানদের আগমন ঘটেনি। উত্তর ভারতে সেই সময় শাসন করছেন প্রভাকর বর্ধন নামের একজন শাসক। বাংলায় তখন চলছে গৌড় অধিপতি শশাঙ্কের শাসন। গোটা ভারত জুড়ে সেই সময়ে হিন্দু নবজাগরণের হিড়িক লেগেছে। একে একে প্রতিষ্ঠা হয়ে চলেছে নতুন নতুন দেব মন্দির। আমি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমার জন্মের পূর্বে একদল লোক এই স্থানে কুয়ো তৈরির উদ্দেশ্যে মাটি খুঁড়তে শুরু করে।
মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে হঠাৎ বেরিয়ে পড়ে একটি ধাতুর তৈরি নাম না জানা এক দেবী মূর্তি। আমার চারপাশে তখন জনবসতিপূর্ণ একটি গ্রাম। সেই মূর্তি নিয়ে গ্রামে শোরগোল পড়ে গেল। স্বয়ং মহারাজ শশাঙ্ক এলেন সেই মূর্তি স্থাপন করে আমায় গড়ে তোলার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে। অনতিবিলম্বে দক্ষ কারিগরদের হাতে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমি জন্মগ্রহণ করলাম। আমার অন্দরমহলে গর্ভগৃহে স্থাপিত হলো নাম না জানা সেই দেবী মূর্তি।
একটি স্মরণীয় দিন:
আমার এই দীর্ঘ জীবনে অসংখ্য দিনের কথা স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হলেও বহু আগের একটি দিনের কথা আমার বিশেষভাবে স্মরণে আছে। সেই দিন সকাল থেকেই ছিল আকাশ মেঘলা। মাঝেমাঝেই আকাশে গুরু গর্জন করে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা তাদের রোজকার জীবনে ব্যস্ত। হঠাৎ সেদিন সন্ধ্যার দিকে গ্রামে ডাকাত পড়লো।
একদল ভীষণ দর্শন ডাকাত নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর তরোয়াল, বর্শা, লাঠি ইত্যাদি অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অসংখ্য নিরীহ গ্রামবাসী তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে বেঘোরে প্রাণ দিল। আর কিছু নারী তাদের সম্মান বাঁচাতে কিছু গহনা নিয়ে আশ্রয় নিল আমার গর্ভগৃহের পিছন দিকে একটি ঘরে। না জানি কোথা থেকে ডাকাতেরা তা জানতে পেরে আমার দিকে তেড়ে এলো।
তরোয়াল আর বর্শা নিয়ে কয়েকজন ডাকাত আমার ভেতর প্রবেশ করতে যাবে এমন সময় হঠাৎ আকাশে ভীষণ গর্জন করে বজ্রপাত হলো ঠিক আমার চূড়ার সামনে। সেই ভীষণ বজ্রপাতে দুজন ডাকাত যেমন মারা পড়ল তেমনি আমার একটি অংশ চিরকালের জন্য ভেঙে পড়ল। এই দৃশ্য দেখে ডাকাতেরা ভয়ে পালিয়ে গেল। সেদিন আমার মনে হয়েছিল ঈশ্বর তার সন্তানদের নিজের গৃহে আশ্রয় দিয়ে রক্ষা করলেন। সেদিনের পর থেকেই আমার নাম হয়ে গেল জাগ্রত দেবীর মন্দির।
ইতিহাসে আমার ঐতিহ্য:
এই দীর্ঘ জীবনে আমি আমার চারপাশের পটচিত্র বহুবার বহুরকম ভাবে বদলে যেতে দেখেছি। আমি অপরাজেয় গৌড় অধিপতি শশাঙ্কের মৃত্যু দেখেছি। আমিও ভারতের ইতিহাসে মাৎস্যন্যায় দেখেছি। দেখেছি পাল বংশের রাজাদের সদর্প শাসন। আমি এ বাংলার মানুষের ওপর বর্গীদের নিশংস আক্রমণ দেখেছি।
খাজনার লোভে নিরীহ চাষীদের উপর নবাবের অত্যাচার দেখেছি। তারও বহু পরে যখন আমার চারপাশে জঙ্গল গজিয়েছে তখন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা বিপ্লবীদের কতবার আশ্রয় দিয়েছি আমার গর্ভগৃহের পাশের সেই ঘরটায়, তার ইয়ত্তা নেই। এ পবিত্র ভূমির এত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজ আমি নিজেই এক জ্বলন্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন হয়ে গিয়েছি।