1942 খ্রীষ্টাব্দের ভারত ছাড়াে আ
ন্দোলন সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখাে।
Answers
Answer:
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ গণ আন্দোলন ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ, ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা, রাজনৈতিক সংকট প্রভৃতি কারণে ভারত ছাড়ো আন্দোলন হয়। ব্যর্থ হলেও বিভিন্ন দিক থেকে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। সরকার জাতীয় নেতাদের গ্রেফতার করেছিল। কংগ্রেস সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তবুও জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এত ব্যাপক জন জাগরণ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পর আর ঘটেনি। এই জন জাগরণ ব্রিটিশ বিরোধী ছিল। ফলে ব্রিটিশ রাজের মর্যাদাহানি ঘটে। ব্রিটিশ সরকারের মর্যাদা রক্ষার জন্য যুদ্ধ শেষে মন্ত্রী মিশন ভারতে আসে।এই গণ আন্দোলন প্রমাণ করে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। এর মাত্র পাঁচ বছর পর ভারত স্বাধীন হয়।
Explanation:
ভারত ছাড় আন্দোলন, ১৯৪২ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে শ্বেতাঙ্গ-বিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপক আন্দোলন (Quit India Movement, 1942)। ক্রিপস মিশন এর অস্পষ্ট প্রস্তাবাবলি- যেমন, যুদ্ধ পরবর্তীকালে ভারতের জন্য ডোমিনিয়ন মর্যাদা প্রদান, প্রাদেশিক আইনসভা ও দেশীয় রাজ্যগুলির দ্বারা সংবিধান প্রণয়ন কমিটি নির্বাচন, প্রদেশগুলির এতে যোগদান করা না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ধারা, যুদ্ধে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের আশু অংশগ্রহণ কিন্তু ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রাখা প্রভৃতি কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারে নি। বরং এ প্রেক্ষিতে বলকান উপদ্বীপের মতো ভারতের ভাগ্য বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দেয়। মালয়, বার্মা ও সিঙ্গাপুর থেকে ব্রিটিশদের কলঙ্কজনক পলায়নের ফলে তাদের অধীনস্থ ভারতীয়দের নিজেদেরকেই আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে হয়। এসব ভারতীয়ের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অবর্ণনীয় দুর্দশাপূর্ণ অবস্থা, ভারতের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত শ্বেতাঙ্গ সৈন্যদের দ্বারা ভারতীয়দের ওপর জাতিগত বিদ্বেষমূলক আচরণ, সকল প্রকারের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যুদ্ধের কাজে লাগানোর কারণে সম্ভাব্য জাপানি আক্রমণের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের বাংলায় অনুসৃত ‘পোড়ামাটি নীতি’, যুদ্ধকালীন জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারী এবং মুনাফাখোরদের দৌরাত্মে সবকিছুই শ্বেতাঙ্গ-বিরোধী উত্তেজনা সৃষ্টি করতে বিশেষ অবদান রাখে। সর্বোপরি, যুদ্ধের শুরু থেকেই ১৯৩২ সালের আদলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের ব্যাপক কঠোর নীতি গ্রহণ করার প্রয়াস ছিল।
৯ আগস্ট ভোরে কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তার দেশব্যাপী এক নজিরবিহীন গণরোষের সৃষ্টি করে, যা বাংলার শহরগুলিতে, বিশেষ করে বড় শহরগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।
ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রধান তিনটি পর্ব দেখা যায়। প্রথম পর্বে এ আন্দোলন প্রধানত শহর অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। এ পর্যায়ে প্রধান শহরগুলিতে হরতাল, ধর্মঘট, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ ছিল লক্ষণীয় বিষয়। এ পর্বের আন্দোলন ছিল খুবই ব্যাপক এবং সহিংস। কিন্তু দ্রুততার সাথেই এ আন্দোলনকে দমন করা হয়।
আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় আগস্টের মধ্যভাগ থেকে। এ পর্যায়ে জঙ্গী ছাত্ররা বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়ে। তারা যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয় এবং একই সঙ্গে উত্তর ও পশ্চিম বিহার, উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চল, বাংলার মেদিনীপুর জেলা এবং মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ও উড়িষ্যার বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। এ সময় বেশ কয়েকটি অঞ্চলে স্বল্প স্থায়ী আঞ্চলিক ‘জাতীয় সরকার’ও গঠিত হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে আন্দোলনের তৃতীয় পর্ব শুরু হয়। এ পর্বের বৈশিষ্ট্য হলো শিক্ষিত যুবক সম্প্রদায় ও কৃষক দলের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা এবং গেরিলা যুদ্ধ। এ সময়ে মেদিনীপুরের তমলুক, মহারাষ্ট্রের সাতারা, উড়িষ্যার তালচের অঞ্চলে এই জাতীয় সরকার কাজ করছিল। তিনটি পর্বের আন্দোলনকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে দমন করা হয়। আন্দোলন দমন করতে সরকার আকাশ থেকে মেশিনগানও ব্যবহার করেছিল।
ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রকৃতি সম্পর্কে বেশ মতবিরোধ আছে। এ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, এটা কি কোন স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব, নাকি একটি সুসংগঠিত বিদ্রোহ। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির (বোম্বাইর) অধিবেশনে বিখ্যাত ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রস্তাব পাস হয় এবং পরপরই যতদূর সম্ভব ব্যাপকভাবে অহিংস পথে গান্ধীর নেতৃত্বে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। প্রস্তাবের সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ একটি অতিরিক্ত ধারা সংযোজিত হয় এবং তা হলো- কংগ্রেস নেতৃত্বকে যদি গ্রেপ্তারের মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে প্রত্যেক ভারতবাসী যিনি স্বাধীনতা চান এবং তার জন্য সংগ্রাম করেন তিনি নিজেই তার পথপ্রদর্শক হবেন। ১৪ জুলাইর ওয়াদা ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবেও সামাজিক র্যাডিক্যালিজমের বিশেষ বৈশিষ্ট্যাবলি উল্লিখিত হয়। ২৭ এপ্রিল থেকে ১ মে পর্যন্ত সময়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশনে গান্ধীর কড়া নীতিকে একযোগে সমর্থন করেন ডানপন্থী প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ ও কৃপালনী এবং সমাজতন্ত্রী অচ্যুত পাটওয়াবর্ধন ও নরেন্দ্রদেব। জওহরলাল প্রথমদিকে দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও পরিশেষে গান্ধীর নীতিকেই সমর্থন করেন এবং একমাত্র কমিউনিস্টরাই ভারত ছাড় প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।
ভারত ছাড় আন্দোলন চলাকালীন এবং পরে ব্রিটিশরা টোটেনহ্যামের প্রতিবেদনের মতো দলিল পত্রে সমগ্র বিস্ফোরণকে অক্ষ শক্তিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ‘পঞ্চম বাহিনী’র সুচিন্তিত ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করে। তবে এ ব্যাখ্যা ছিল নিতান্তই হাস্যকার, কারণ কংগ্রেস বরাবরই ছিল ফ্যাসিবাদ-বিরোধী এবং ৯ আগস্ট ভোরে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার পরও ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে চলে। এই ব্যাখ্যার কারণে আলাপ-আলোচনার পথই শুধু রুদ্ধ হয় নি, বরং মনে হয় গোটা ব্যাপারটাই ছিল বিশেষ কার্য পদ্ধতি অনুসরণ করে শেষ সীমায় পৌঁছানোর একটা প্রয়াস; আর সেই সঙ্গে দরকষাকষিরও একটা কৌশল মাত্র। কিন্তু এর পরেই যে বিস্ফোরণ হয় তার একমাত্র কারণ এই যে, ব্রিটিশরা সর্বাত্মকভাবে দমননীতি প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্রিটিশরা এ অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি যে, ৯ আগস্টের পূর্বে কংগ্রেস সত্যিই এক হিংসাত্মক বিদ্রোহের পরিকল্পনা করে।
বাস্তবিকপক্ষে, এ আন্দোলন ছিল প্রাথমিক এবং ব্যাপকভাবে স্বতঃস্ফূর্ত। বহুবিধ কারণ এবং এ আশায় আন্দোলন ব্যাপক ভাবে বিস্তার লাভ করে যে, শীঘ্রই ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটছে। ব্রিটিশ আমলাদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং প্ররোচনা পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে ঠেলে দেয়। মালয় ও বার্মায় আর্থিক ক্ষতি সাধিত হওয়ায় ভারতীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন অংশ কিছু সময়ের জন্য হলেও গোপনে আন্দোলনকে সহায়তা করতে উৎসাহিত হয়।