একুশে বইমেলা সম্পর্কে কমপক্ষে ৫০০ শব্দের একটি রচনা
Answers
গ্রন্থমেলা ১৯৮৪ : নাম পরিবর্তন, ‘বাংলা একাডেমী বইমেলা’ থেকে ‘বাংলা একাডেমী অমর একুশে বইমেলা’
১৯৮৪ সালে গ্রন্থমেলার নাম পরিবর্তিত হয়। ‘বাংলা একাডেমী গ্রন্থমেলা’-র নাম হয় ‘বাংলা একাডেমী অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। কোন পটভূমিতে এবং কেন নাম পরিবর্তিত হলো এবং এর গ্রহণযোগ্যতা কেমন হয়েছে এসব বিষয়ে নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। পরিবর্তিত নামে অনুষ্ঠিত ১৯৮৪ সালের গ্রন্থমেলা অন্যান্য বারের তুলনায় অধিকতর সংগঠিত ও সুশৃংখল ছিল। ৭ই ফেব্রুয়ারি বিকেল পৌনে ৫টায় মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। মেলার উদ্বোধক ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ ইব্রাহীম। বিশেষ অতিথি ছিলেন মাসিক আল ইসলাহ পত্রিকার সম্পাদক ও ‘সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদ’-এর প্রবীণ সংগঠক মুহম্মদ নুরুল হক। স্বাগত ভাষণ দেন গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ও একাডেমির বিক্রয় ও বিপণন উপবিভাগের উপপরিচালক হাবীব-উল-আলম। পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক মনজুরে মওলা।
এই বছর মেলায় নতুন অনেক বিষয় প্রবর্তিত হয়। নতুন প্রবর্তিত বিষয়গুলোর কিছু পরবর্তীকালে গ্রন্থমেলায় স্থায়ীভাবে গৃহীত হয়। এই বছর মেলা পরিচালনার জন্য একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদ ৮ সদস্যের একটি ‘পরিচালনা কমিটি’ গঠন করে। স্টল নির্মাণের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় থেকে টিনের ব্যবস্থা করা হয়। মেলার প্রচারের জন্য চারটি জাটিয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে কেবল বাংলাদেশে প্রকাশিত বই বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়। তবে বিদেশী বই ‘শুধুমাত্র প্রদর্শনীর জন্য বিক্রয়ের জন্য নয়’ এই শর্তে প্রদর্শনীর সুযোগ দেওয়া হয়। এবারই প্রথম লটারির মাধ্যমে স্টল বরাদ্দের নিয়ম করা হয়। যাদের কমপক্ষে পাঁচটি বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা রয়েছে শুধু তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। এবারের মেলায় একটি নতুন সংযোজন ছিল ‘তথ্যকেন্দ্র’। মেলা সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, তথ্য প্রদান ও তথ্য প্রচারের জন্য এই তথ্যকেন্দ্র খোলা হয়। এখান থেকে নতুন বইয়ের খবর সারাক্ষণ প্রচারিত হতো। মাঝে মাঝে যন্ত্রসঙ্গীত ও একাডেমির অনুষ্ঠানের ক্যাসেট বাজানো হতো। ‘আজকের বই’ নামে মেলা প্রাঙ্গণে একাধিক বোর্ড স্থাপিত হয়। এসব বোর্ডে যেদিন যে বই প্রকাশিত হতো সেদিন সেই বইয়ের প্রচ্ছদ ও তথ্যাদি প্রদর্শিত হতো। লেখকদের আড্ডার জন্য ‘বিনোদন কেন্দ্র’ ছিল। একাডেমি মেলা উপলক্ষে দুইটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিল। একটির শিরোনাম ছিল ‘বিশেষ প্রদর্শনী’ এবং অন্যটি ছিল ‘বিজ্ঞান প্রদর্শনী’।১
এই মেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমির আয়োজনে বিশেষ প্রতিকৃত প্রদর্শনীর ব্যবস্থা ছিল। এতে ১১ জন প্রখ্যাত সাহিত্যিকের প্রতিকৃতি প্রদর্শিত হয়। গ্রন্থমেলার ইতিহাসে ১৯৮৪ সালে প্রথম ‘লেখকদের জন্য’ নাম দিয়ে লেখকদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। এই ‘লেখকদের জন্য’-ই পরের বছর থেকে ‘লেখক আড্ডা’ বা ‘লেখক কুঞ্জ’ নামে পরিচিত হয়। এই বছর মেলা চলে ৭ থেকে ২৯শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। মেলায় মোট ৮০টি স্টল ছিল। ১৯৮৪ সালে আয়োজিত প্রদর্শনী সম্পর্কে দৈনিক সংবাদ-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় : ‘এবারের মেলার অন্যতম আকর্ষণ বিশেষ প্রদর্শনী। এতে বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তৈলচিত্র ও ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বিভিন্ন সময়ের ছবি স্থান পেয়েছে। অন্যদিকে বাংলা বর্ণগুলোর ও সংখ্যাগুলোর ক্রমবিবর্তন দেখানো হয়েছে দু’টি বোর্ডে। এছাড়া এবারের মেলায় ‘রাশিফল’ নামক ব্যতিক্রমী একটি স্টল খোলা হয়েছে।’২ সেই বছরের বইমেলা বর্তমানের মতো ‘কেবল বইয়ের মেলা’ ছিল না। বইয়ের সঙ্গে নাটকের, আবৃত্তির ক্যাসেট, শিল্পীদের আঁকা ছবিও বিক্রির ব্যবস্থা ছিল। ‘বই মেলায় নাটক ও আবৃত্তির ক্যাসেট’ শীর্ষক একটি পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয় :
বাংলা একাডেমীর বই মেলায় থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীর স্টলে জনপ্রিয় নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘দুই বোন’ এবং ভাস্কর বন্দোপাধ্যায়ের আবৃত্তি ‘প্রাণে বাজায় বাঁশি’র ক্যাসেট পাওয়া যাচ্ছে। প্রাণে বাজায় বাঁশিতে রয়েছে মধুসূধন থেকে আবুল হাসান পর্যন্ত বাংলা কবিতার প্রতিনিধিত্বশীল সংগ্রহ।
শিল্পকলা একাডেমীর স্টলে কামরুল হাসানসহ বিশিষ্ট শিল্পীদের আঁকা ছবির প্রিন্ট বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি মাত্র ১০ টাকা দামে। ৩
একুশে উদযাপন ও বইমেলাকে কেন্দ্র করে একাডেমি প্রতিদিন আলোচনা সভার ব্যবস্থা করেছিল। ৮ থেকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি প্রতিদিন মূল মঞ্চে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইয়ের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রবন্ধ পাঠ এবং পঠিত প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। এই বছর ২১শে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে অনেক দর্শক শ্রোতার সমাগম ঘটে। এই দিনের দর্শক উপস্থিতি সম্পর্কে একাডেমির প্রতিবেদনে উল্লেখ বলা হয় : ‘বাংলা একাডেমীর আর কোন অনুষ্ঠানে কোন দিনই এত বড় জনসমাবেশ হয়নি।’৪ প্রতিদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। দেশের প্রখ্যাত শিল্পীরা এসব অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ১৯৮৪ সালের বইমেলায় বাংলা একাডেমি মোট ১,৭০,৩৯৪.২৪ (এক লাখ সত্তর তিন শত চুরানব্বই টাকা চব্বিশ পয়সা) টাকার বই বিক্রি করে।
বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলা যে পরবর্তীকালে দেশের মানুষের কাছে মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীলতা চর্চার অন্যতম গুরত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয় তার আভাস ১৯৮৪ সালেই পাওয়া যায়। বইমেলাকে শুরু থেকেই একটি সংবেদনশীল স্থান হিসেবে সাধারণ মানুষ গণ্য করেছে। এই বছর ‘রাশিফল’ নামক যে স্টলটিকে ‘ব্যতিক্রমী ঘটনা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো সেই ধরনের স্টল বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানে আদৌ গ্রহণ করা যায় কি না এই প্রশ্নও উত্থাপিত হয়। সংবাদ-এ প্রকাশিত ‘বাংলা একাডেমীর বইমেলা প্রসঙ্গে’ শীর্ষক একটি পত্রে জামালপুরের বরুয়াজানী থেকে ফজলুল করিম নামের একজন পাঠক উল্লেখ করেন